অনেক
সময় অনেকেরই নাকের দুর্গন্ধ হয়ে থাকে। নাকের এ দুর্গন্ধ বেশির ভাগ
ক্ষেত্রেই রোগী নিজেই অনুভব করে থাকেন। তবে একটি রোগ আছে, যে ক্ষেত্রে
রোগীর নাকের দুর্গন্ধে অন্যরা নাক চেপে থাকেন বা দূরে সরে যান। কিন্তু রোগী
নিজের নাকের দুর্গন্ধ অনুভবই করেন না। কারণ, বিশেষ সেই রোগটির কারণে রোগীর
নাকের ঘ্রাণশক্তি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নষ্ট হয়ে যায়। নাকের এ দুর্গন্ধ
কারও ক্ষেত্রে সাময়িক, কারও ক্ষেত্রে স্থায়ী রূপ লাভ করে। নাকের এ
ব্যতিক্রমী রোগের নাম এট্রোফিক রাইনাইটিস। এ রোগে নাকের ঝিল্লি ধীরে ধীরে
মরে যায়। নাকের দুর্গন্ধ অনেক কারণে হয়ে থাকে। তবে যেসব কারণে সাধারণত নাকে
দুর্গন্ধ হয় এবং রোগী নিজেও তা টের পান,
সেগুলো হচ্ছে—সাইনোসাইটিস, নাকের
প্রদাহ বা ইনফেকশন, নাকের মধ্যে বাইরের কোনো জিনিস ঢুকে থাকা ইত্যাদি।
এট্রোফিক রাইনাইটিস নাকের এমন একটি রোগ, যাতে নাসারন্ধ্রের ঝিল্লি এবং
নাকের ভেতরের দুই পাশের হাড় বা টারবিনেটগুলোকে আবৃত করে রাখা ঝিল্লির
দীর্ঘমেয়াদি এমন একটি পরিবর্তন হয়, যাতে ঝিল্লিগুলো ক্রমশ মরে গিয়ে চুপসে
যেতে থাকে। ফলে নাকের মধ্যকার জায়গা বেড়ে যায় এবং নাকের মধ্যে মরা ঝিল্লির
স্তর বা বষ্টি খসে পড়ে, পচে যায় ও দুর্গন্ধ ছড়ায়। এট্রোপিক রাইনাইটিস
সাধারণত দুই ধরনের—প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি।
প্রাইমারি এট্রোফিক রাইনাইটিস
প্রাইমারি এট্রোফিক রাইনাইটিসের কারণ এখনো অজানা। তবে কারণ অনুসন্ধানের
জন্য কিছু তত্ত্বকে এ ক্ষেত্রে দায়ী বলে গণ্য করা হয়। যেমন— রোগের
উত্তরাধিকার: যদি পরিবারে কারও এ রোগ থাকে, তবে অন্যদের ভবিষ্যতে এ রোগ হতে
পারে বলে মনে করা হয়।
হরমোনজনিত বিঘ্নতা: এ ক্ষেত্রে সাধারণত পিউবারটি বা যৌবনোদ্গমের সময় এ
সমস্যা শুরু হয়। মেয়েদের মধ্যেই বেশি হয়। দুর্গন্ধ এবং নাকে মরা ঝিল্লির
শুকনো খণ্ড বা ক্রাস্ট জমার প্রবণতা মেনোপজ বা ঋতু বন্ধ হওয়ার পর কমে যায়
বা চলে যায়।
বর্ণভেদ: সাদাদের মধ্যে এ রোগের প্রবণতা কালোদের তুলনায় কিছু বেশি।
অপুষ্টিজনিত কারণ: ভিটামিন এ, ডি এবং আয়রন অথবা খাবারের অন্য কোনো খাদ্যোপাদানের অভাবে এটি হতে পারে।
ইনফেকশন: এট্রোফিক রাইনাইটিসের রোগীর নাকের শ্লেষ্মা পরীক্ষা করে যেসব
জীবাণুর উপস্থিতি লক্ষ করা যায়, সেগুলো হলো ক্লেবসেলা ওজায়েনা, ডিপথেরয়েড,
পি ভালগারিস, ই-কোলাই, স্ট্যাফাইলোক্কাই, স্ট্রেপটোক্কাই। তবে এসব জীবাণুর
সবই দ্বিতীয় ধাপে ইনফেকশন সৃষ্টি করে দুর্গন্ধ ছড়ায়।
স্ববিরোধী দেহ প্রতিরক্ষা: ভাইরাল ইনফেকশন এবং অন্য কিছু অচেনা উপাদান রয়েছে, যা নাকের এ সংবেদনশীল প্রতিক্রিয়াকে উসকে দেয়।
যেসব উপসর্গ ও লক্ষণ দেখা যায়
সাধারণত মেয়েদের এ সমস্যা বেশি হয়ে থাকে। যৌবনের শুরুতেই এ রোগের লক্ষণ ও
উপসর্গগুলো প্রকাশ পেতে থাকে। দুর্গন্ধের জন্য রোগীর কাছে কেউ যেতে চায় না।
কিন্তু নাকের ঘ্রাণশক্তি বহনকারী স্নায়ু নষ্ট হওয়ার কারণে রোগী এ
দুর্গন্ধের কিছুই অনুভব করে না। এ ছাড়া যদিও রোগীর নাকের ভেতরের পথ প্রশস্ত
থাকে, তার পরও রোগী নাক বন্ধ থাকার অভিযোগ করে থাকে। এর কারণ হচ্ছে রোগীর
নাকের মধ্যে মরা চামড়ার অনেকগুলো খণ্ড বা বষ্টি আটকে থাকে, ফলে নাক বন্ধ
মনে হয়। এই বষ্টিগুলো টেনে বের করার সময় নাক দিয়ে রক্ত পড়তে পারে। নাক
পর্যবেক্ষণ করলে রোগীর নাকের মধ্যে সবুজাভ কিংবা হালকা ধূসর রঙের বষ্টি বা
ময়লা খণ্ড দেখা যায়। নাকের পাশের দিকে অবস্থিত শেডের মতো ওপর-নিচ করে বসানো
তিনটি হাড় ক্ষয় হয়ে গিয়ে সামান্য উঁচু দাগের মতো মনে হয়। অনেক সময়
মধ্যবর্তী দেয়ালটিতে ছিদ্র থাকতে পারে। কারও কারও নাক বসে যেতে পারে। নাকের
সাইনাসের এক্স-রে করে সাইনাসগুলো ঘোলাটে দেখা যায়। সাইনাসগুলো পরিপূর্ণতা
লাভ না করার জন্য আকারে ছোট হয়। সাইনাসের দেয়ালগুলো মোটা থাকে।
চিকিৎসা
ওষুধে চিকিৎসা: শুধু ওষুধে এ রোগ পুরোপুরি সারবে, এমনটি নিশ্চিত করে বলা
যায় না। চিকিৎসার উদ্দেশ্য হচ্ছে, নাককে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্ত
রাখা। এ জন্য নাক পরিষ্কারের ব্যবস্থা করা হয়। একটি বিশেষ সিরিঞ্জের
(হিগিনসন্স সিরিঞ্জ) সাহায্যে ক্ষারজাতীয় দ্রবণ দিয়ে নাক দৈনিক দু-তিনবার
পরিষ্কার করা যায়। এ ছাড়া গ্লিসারিনে ২৫ শতাংশ গ্লুকোজ মেশানো সলিউশন নাক
পরিষ্কার করার পর নাকে দিতে হয়। এই সলিউশন প্রোটিন নষ্টকারী জীবাণুকে বেড়ে
উঠতে বাধা দেয়। নাকের মধ্যে স্থানীয়ভাবে অ্যান্টিবায়োটিক মলম বা স্প্রে
ব্যবহার করা যায়। অস্ট্রাডিওল স্প্রে ব্যবহার করা যেতে পারে আক্রান্ত
স্থানের রক্তের প্রবাহ বাড়ানোর জন্য। স্ট্রেপটোমাইসিন নামক ওষুধও দেওয়া
যেতে পারে।
অপারেশনে চিকিৎসা: ইয়াংস অপারেশন নামে একটি অপারেশন আছে। এই অপারেশনের
মাধ্যমে নাকের ছিদ্র অন্তত ছয় মাসের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে অধিকাংশ
ক্ষেত্রেই নাক খুলে দেওয়ার পর আবারও একই অবস্থা দেখা দেয়।
সেকেন্ডারি এট্রোফিক রাইনাইটিস
নির্দিষ্ট কিছু রোগের কারণে যখন একই সমস্যা হয়, তখন তাকে বলা হয় সেকেন্ডারি
এট্রোফিক রাইনাইটিস। যেসব রোগে এ অবস্থা হয়, সেগুলো হলো সিফিলিস, লেপ্রোসি
বা কুষ্ঠ, লুপাস এবং রাইনোস্ক্লেরোমা, কোনো রোগের জন্য নাকে রেডিওথেরাপি
দিলে কিংবা নাকের কিছু অপারেশনে (অতিরিক্ত টারবিনেকটমি) একই ধরনের সমস্যা
হতে পারে। নাকের হাড় একদিকে বাঁকা হয়ে থাকলে অন্যদিকের ছিদ্রতেও একই সমস্যা
তৈরি হতে পারে।
রোগের পরিণাম
এ রোগ সহজে সারে না। রোগ সারানোর ব্যাপারে রোগীকে বেশ কিছু ব্যবস্থা
গ্রহণসহ বিভিন্ন চিকিৎসার মধ্যে থাকতে হয়। নিয়মের একটু ব্যত্যয় হলেই রোগের
উপসর্গগুলো বেড়ে যায়। তবে মধ্যবয়সে অনেকেরই রোগ ভালো হয়ে যায়।
সজল আশফাক
সহযোগী অধ্যাপক, নাক, কান ও গলা বিভাগ, হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ০৩, ২০১২
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
“প্রযুক্তিকে ভালবাসুন, প্রযুক্তির সাথে থাকুন সবসময়, প্রযুক্তির আলো ছড়িয়ে দিন বিশ্বময়”